hajj

সৌদি আরবের শাসকরা মুসলিমদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। অথচ, সৌদি আরব নিজেদেরকে ইসলামের কেন্দ্র দাবি করে থাকে। এর কারণ হলো মুসলিমদের দুই পবিত্র স্থান মক্কা আর মদিনার অবস্থান সৌদি আরবে। আর মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ইবাদত হজের আয়োজনও সৌদি আরবকেই করতে হয়।

তুরস্কের প্রেসিডেন্সি অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স বা দিয়ানাতের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, মেটাভার্সের মাধ্যমে পবিত্র কাবা ঘর সফর করা হলে সেটা কখনও সত্যিকারের হজ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। মাসব্যাপী আলোচনার পর দিয়ানাত এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, মেটাভার্সের মাধ্যমে কাবা সফর করার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। তবে, এ ধরণের সফর কখনও সত্যিকারের ইবাদত হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

দিয়ানাতের হজ ও উমরাহ সার্ভিস বিভাগের ডিরেক্টর রেমজি বিরকান বলেন, মেটাভার্সের মাধ্যমে হজ হতে পারে না। তিনি বলেন, ইমানদার ব্যক্তিরা মেটাভার্সের মাধ্যমে কাবা দেখতে পারেন; কিন্তু এটা কখনই সত্যিকারের ইবাদত হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, ইবাদতের জন্য মানুষের পা পবিত্র ওই মাটিতে পড়তে হবে। বিরকান বলেন, হজের জন্য শারীরিকভাবে পবিত্র এই ভূমিতে যেতে হবে এবং এভাবেই সবসময় হজ পালিত হবে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরব ‘ভার্চুয়াল ব্ল্যাক স্টোন ইনিশিয়েটিভ’ গ্রহণ করে। এরপর থেকেই কাবার মেটাভার্স ভার্সনটি সারা বিশ্বেই মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র জায়গাটিকে মেটাভার্সের মধ্যে নিয়ে আসার ফলে মুসলিমরা এখন মর্যাদাপূর্ণ হাজরে আসওয়াদ নামের এই পবিত্র পাথরটিকে ঘরে বসে মেটাভার্সের মাধ্যমে দেখতে পারবেন। বাস্তবে এই পাথরটি রয়েছে কাবা ঘরের কোনায় দেয়ালের সাথে সংযুক্ত।

এই পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এক বিবৃতিতে সৌদি আরবের কর্মকর্তারা বলেন, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মুসলিমরা মক্কায় হজ করার আগেই হাজরে আসওয়াদকে ভার্চুয়ালি দেখতে পারবে। বিরকান এই পদক্ষেপকে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বা ভিআর-এর মাধ্যমে ইস্তাম্বুলের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর দেখার সাথে তুলনা করেন। তিনি বলেন, এটা ভিআর চশমা পড়ে জাদুঘর দেখার মতো।

কাবা ঘরের প্রচারণার জন্য সৌদি আরব এই ভার্চুয়াল পর্যটন কর্মসূচি শুরু করেছে। এই প্রজেক্টটি তৈরি করেছে সৌদি আরবের এক্সিবিশান অ্যান্ড মিউজিয়ামস অ্যাফেয়ার্স এজেন্সি। উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটির সাথে মিলে তারা এই কাজটি করছে। এই প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা হলো হারামাইন। হারামাইন শব্দের অর্থ হলো দুই পবিত্র স্থান। মক্কা ও মদিনা- বিশেষ করে এই দুই জায়গায় অবস্থিত দুই পবিত্র মসজিদকে একসাথে হারামাইন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

সৌদি আরবের পতাকা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সৌদি পতাকায় ইসলামের কালেমা খচিত থাকায় সেটার সাথে মুসলিমদের আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। সৌদি পতাকায় এই কালেমার অর্থ হলো ইসলাম ধর্মের জন্ম হয়েছে এই ভূখণ্ডে।

সম্প্রতি সৌদি আরবের অনির্বাচিত শুরা কাউন্সিল এই পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তবে বিতর্কের মুখে সেখান থেকে পিছু হটেছে কাউন্সিল। গালফ নিউজ জানিয়েছে, শুরা কাউন্সিল পরে নিশ্চিত করেছে যে, ওই পরিবর্তনের প্রস্তাব কার্যকর করা হবে না। এমন সময় শুরা কাউন্সিল এ বিষয়টিকে আলোচনায় আনলো, যখন দেশের যুবক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি জাতীয়তা এবং জাতীয় আত্মপরিচয়ের উপর বেশি করে জোর দিতে শুরু করেছেন।

এই শুরা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত যদিও বিদ্যমান আইন ও কাঠামোর উপর সরাসরি কোন প্রভাব ফেলে না। তবে, অন্য কারণে এই ভোট তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা হলো, এই কাউন্সিলের সব সদস্যকে বাদশাহ নিজে নিয়োগ করে থাকেন। এবং সাধারণত তাদের সিদ্ধান্তের মধ্যে ক্ষমতাসীন নেতাদের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে থাকে।

রাষ্ট্র-ঘনিষ্ঠ মিডিয়ায় বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকা, শ্লোগান ও জাতীয় সঙ্গীতে কিছু সংশোধনী আনার ব্যাপারে শুরা কাউন্সিল মত দিয়েছিল। তবে সেখানে বিষয়বস্তু বদলানোর প্রস্তাব ছিল না। কাউন্সিল অবশ্য এ ব্যাপারে বিস্তরিত কিছু বলেনি। স্থানীয় মিডিয়াগুলো আরও বলেছে, প্রস্তাবে জাতীয় প্রতীক ও জাতীয় পতাকার ব্যবহারের নিয়মাবলী আরও সুনির্দিষ্ট করে দিতে বলা হয়েছে। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে এবং এগুলোর যাতে অবজ্ঞা না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

সৌদি আরবের পতাকার অমর্যাদা করার কারণে সম্প্রতি চারজন বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করে সৌদি পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, তারা ডাস্টবিনে জাতীয় পতাকা ফেলে দিয়েছিল।

রাষ্ট্রায়ত্ব সৌদি প্রেস এজেন্সি বলেছে, প্রায় ৫০ বছর আগে জাতীয় পতাকার ব্যাপারে যে রাজকীয় ফরমান জারি করা হয়েছিল, সেখানেই কিছু সংশোধনী আনার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছিল শুরা কাউন্সিল। তবে জাতীয় পতাকা বা হাজরে আসওয়াদ নিয়ে যে সব বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এগুলো হঠাৎ করে ঘটেনি। বর্তমান বাদশাহ ক্ষমতায় আসার পর ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে এমবিএস যখন দায়িত্ব নেন, তখন থেকেই এ ধরণের তৎপরতা শুরু হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিযোগ ও অসন্তুষ্টি বেড়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কোন তৎপরতা ও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অনেক সময় এমনও মনে হয়েছে যে, সৌদি আরবের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে ইসরাইল আর যুক্তরাষ্ট্রের মিলই যেন বেশি। অথচ এই দুই দেশই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

মক্কা ও মদিনার সংরক্ষক হিসেবে সৌদি আরবের নেতারা বস্তুগত ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচুর লাভবান হয়েছেন। প্রতি বছর হজের জন্য সৌদি আরবে দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ সফর করেন। এই হজের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ভিন্ন বর্ণ, জাতি, আর পরিচয়ের মানুষ মক্কা ও মদিনায় জড়ো হন।

সৌদি আরব যে সব জায়গা থেকে রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে থাকে। তার একটি হলো মুসলিম দেশগুলোর জেদ্দা-ভিত্তিক সংগঠন অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কো-অপারেশান বা ওআইসি। জেরুসালেমের আল আকসা মসজিদ ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান। এই মসজিদটি ইসরাইলের হামলার শিকার হওয়ার পর ১৯৬৯ সালে ওআইসি গঠিত হয়েছিল; কিন্তু এই ফোরামটিকেও বিতর্কিত করেছে সৌদি শাসকগোষ্ঠি।

৫৭ সদস্যের ওআইসি আকারের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ফোরাম; কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই সংস্থার প্রভাবও কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, রিয়াদ আর তার মিত্ররা ফিলিস্তিন আর কাশ্মীরের মতো মুসলিমদের বিভিন্ন ইস্যুতে কোন ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেনি। মুসলিম দেশগুলোকে দখলদার শক্তিগুলোর হাত থেকে উদ্ধারের জন্য ওআইসিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বরং উল্টো পথে হেঁটেছেন সৌদি আরবের অনভিজ্ঞ ক্রাউন প্রিন্স। এমবিএস এর আগে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের সমর্থক আমেরিকান ইহুদি জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। জ্যারেড কুশনার ছিলেন তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা। তার এই ধরণের পদক্ষেপের কারণে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌদি আরবের ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
তবে, সৌদি শাসকগোষ্ঠির সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে। এতদিন তারা যে সব পদক্ষেপ নিয়েছিল, প্রকৃতিগতভাবে সেগুলো রাজনৈতিক হওয়ায় সাধারণ মুসলিমদেরকে হয়তো সেভাবে নাড়া দেয়নি; কিন্তু ধর্মীয় ইস্যুতে বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে সাধারণ মুসলিমদের মধ্যেও বিরূপ মনোভাব বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে সৌদি আরবের অবস্থানকে যা নিঃসন্দেহে দুর্বল করে তুলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also

ফেরাউনের পথ অনুসরণ করছে ইসরায়েল: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী

সূত্র: ইত্তেফাক  পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক কাকার বৃহস্পতিবার গ…