রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের। ওদিকে তাইওয়ান, বাণিজ্য যুদ্ধ, পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেইজিংয়ের সাথে চরম বৈরীতা ওয়াশিংটনের। যে কারণে দুটি বৃহৎ শক্তিকে এক সাথে মোকাবেলা করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। আবার তাদের এই দুই শত্রু রাষ্ট্র ক্রমশই নিজেদের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করছে। এর ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, আগামী দিনে চীন-রাশিয়ার সম্মিলিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

আসন্ন গ্রীষ্মে উচ্চাভিলাসি এক সামরিক মহড়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আকাশযুদ্ধ, সাগরতলের যুদ্ধ এমনকি হাইপারসনিক অস্ত্র প্রযুক্তিও থাকতে পারে সেই মহড়ায়। সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এর অর্থ হচ্ছে, চীন ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মিত্রতা আরো দৃঢ় হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের সম্পর্ক এতটাই গোপনীয়তার সাথে অগ্রসর হচ্ছে যে, বাইরে থেকে কোন তথ্য পাওয়া বা কোন কিছু আন্দাজ করা সহজ নয়।

সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক জোট, সামরিক মহড়া ও যৌথ প্রতিরক্ষা উন্নয়ন এবং দুই রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক বিবৃতি থেকে মস্কো ও বেইজিংয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আভাস পাচ্ছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। যেসব মার্কিন কর্মকর্তারা আগে এই দুই দেশের যৌথ হুমকির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতেন, তারাও এখন সুর পরিবর্তন করতে শুরু করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিগত ছয় দশকের যে কোন সময়ের চেয়ে মস্কো ও বেইজিং এখন অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ঘনিষ্ঠভাবে বিষয়টির ওপর নজর রাখছেন, তবে পূর্ণ একটি সামরিক জোট হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়েও আন্দাজ করতে পারছেন।

চীন ও রাশিয়ার মাঝে রয়েছে আড়াই হাজার মাইলের দীর্ঘ সীমান্ত। মধ্য এশিয়া, ভারত ও আর্কটিক অঞ্চল নিয়ে দেশ দুটির স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে- যেগুলো মস্কো আর বেইজিংয়ের জোটবদ্ধ হওয়া ঠেকাতে পারে। এছাড়া ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর মতো রাশিয়া আর চীনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা একটি যৌথ কমান্ড স্থাপনের কার্যকারিতাকে সীমিত করে দেবে।

তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধ বৈরীতা দেশ দুটোকে এক বিন্দুতে আনতে পারে। দুটি দেশ বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এক সাথে কাজ করলে সেটি সম্ভব বলেও মনে করে চীন-রাশিয়া। গত জুনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ই বলেছেন, চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক আরো বিস্তৃত ও গভীর হতে প্রস্তুত। আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দেশের সম্পর্ককে ঐতিহাসিক পর্যায়ের হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

গত বছর আগস্ট মাসের কথা- ওয়াশিংটন যখন আফগানিস্তানে পরাজয় ও সৈন্যপ্রত্যহার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, চীন-রাশিয়া তখন যৌথ মহড়া চালিয়েছে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায়। সেই মহড়ায় প্রথমবারের মতো যৌথ কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার ব্যবহার করেছে দেশ দুটির সেনারা। যা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের যৌথ কোন সম্ভাব্য পদক্ষেপের আভাস বহন করে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। প্রায় ১৩ হাজার সৈন্য ও শতাধিক বিমান, ড্রোন, কামান, বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র ও সাজোয়া যান অংশ নিয়েছে চীনের নিংজিয়া অঞ্চলের ওই মহড়ায়। এরপর অক্টোবরে রাশিয়ার পূর্ব উপকূলে দুই দেশ চালিয়েছে নৌ মহড়া।

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিশ্ব্যাবপী হুমকি নিরূপন রিপোর্টে প্রথমবারের মতো চীন ও রাশিয়াকে যৌথ আঞ্চলিক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ অর্জন ব্যহত করতে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে ।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণেই চীন রািশয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়া শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। ওই বছর ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের কারণে রাশিয়ার বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। আবার ইউক্রেন ইস্যুতে গত মাসেও পুতিনের সাথে টেলিফোন আলাপের সময় রাশিয়াকে সরাসরি হুমকি দিয়েছেন জো বাইডেন।

চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরীতা অবশ্য অগ্রসর হচ্ছে কিছুটা ভিন্নভাবে। সরাসরি হুমকি পাল্টা হুমকি নেই, তবে এখানে উভয় পক্ষই ক্রমশ প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হচ্ছে। চীন বেশ কিছুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই যেমন বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছেন চীনে। অন্য দিকে অস্ট্রেলিয়ার সাথে পারমাণবিক সাবমেরিন চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের সাথেও তারা সম্পর্ক রক্ষা করছে। যা ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের প্রতিযোগীতাকে ক্রমশই তীব্র করেছে।

এসব কারণে ওয়াশিংটনের অভিন্ন শত্রু হয়ে উঠেছে মস্কো আর বেইজিং। যেটি তাদের এক বিন্দুতে আনতে ভুমিকা রাখছে। ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি বলেছিলেন, পারস্পারিক শ্রদ্ধার যে ঘাটতি ওয়াশিংটনে রয়েছে তা আমরা কেউ মানতে পারি না। এই রুশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা অন্যের বিষয়ে নাক না গলানোর নীতিতে বিশ্বাস করি। যে কারণে চীনা-রাশিয়া একে অন্যের ঘনিষ্ঠ হতে পারছে।

তাইওয়ানের বিষয়ে নিজেদের অবস্থানের অস্পষ্টতা দূর করে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন- তার দেশ তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলেই মনে করে। সাম্প্রতিক সময়ে মনে হয় না- এর চেয়ে বড় কোন খুশির খবর হতে পারে চীনা শাসকদের কাছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য, জ্বালানী, প্রযুক্তির মতো খাতগুলোতেও চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক জোরালো হয়েছে। গত ৬ বছরে ভ্লাদিমির পুতিন ও শিন জিনপিং ৩০ বারেরও বেশি সাক্ষাৎ করেছেন।

গত কয়েক দশক ধরে চীনের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে আছে রাশিয়া। মাঝখানে কিছুদিন রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা দিলেও ২০১৪ সালে রাশিয়া থেকে চীনের এস-ফোর হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার মাধ্যমে সেই সম্পর্ক আবার জোড়া লাগে। পরের বছর রাশিয়ার তৈরি সু-থার্টি ফাইভ ফাইটার জেট কেনার চুক্তি করে চীন, যার মাধ্যমে মার্কিন যুদ্ধজাহাজে হামলার ক্ষমতা অর্জন করে বেইজিং। ওই চুক্তির কারণে চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also

উত্তেজনার মধ্যে আবার মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন ব্লিঙ্কেন

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আজ বৃহস্পতিবার নতুন করে মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু …