রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশাসন ইউক্রেনের সঙ্গে থাকা দীর্ঘ সীমান্তে লক্ষাধিক সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে। সেইসঙ্গে প্রস্তুত রাখা হয়েছে আধুনিক সব সমরাস্ত্র। পুতিনের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন সেনারা। আদেশ করা মাত্র ইউক্রেনের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানবে রুশ সেনারা।

অপরদিকে, প্রস্তুত ইউক্রেনও। নিয়মিত সেনাবাহিনীর বাইরেও হাজার হাজার বেসামরিক যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। ট্যাংক, মিসাইলসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন করেছে দেশটি। ব্রিটেনসহ অন্যান্য মিত্র দেশ, বিশেষ করে সামরিক জোট ন্যাটোর কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র ইউক্রেনকে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

সব মিলিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, তা সহজেই আঁচ করা যায়। ইউক্রেন থেকে দূতাবাসের স্টাফ ও নাগরিকদের সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।

আমেরিকা ও ব্রিটেনের গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বরাবরের মতো চুপ থাকা পুতিন যেকোনো সময় ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দিতে পারেন। পরিস্থিতি যে সত্যিই নাজুক- সেটা অনুমান করা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দৌড়ঝাঁপে। ইতোমধ্যে ব্রিটেন, জার্মানি ও অন্যান্য মিত্র এবং ন্যাটোর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন তিনি। এরপর মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজে সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঐক্যের ডাক দিয়েছেন বাইডেন। এছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, জার্মান চ্যাঞ্চেলর ও ন্যাটোর মহাসচিব পৃথক পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে মস্কোর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পেন্টাগন জানিয়েছে, যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তাদের সাড়ে ৮ হাজার সেনার বিশাল বহরকে উচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। বলা যায়, এক রাশিয়াকে ঠেকাতে অর্ধ-পৃথিবী এক হচ্ছে। তবে আমেরিকা ও তার মিত্ররা দৌড়ঝাঁপ করলেও এক প্রকার নীরব ভূমিকা পালন করছেন পুতিন। এমনকি অন্য কোনো দেশও এখন পর্যন্ত মস্কোর পক্ষ নিয়ে কথা বলেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নীরবে ছক আঁকছেন রাশিয়ার একনায়ক। প্রশ্ন উঠেছে- বাইডেন ও তার মিত্ররা কি পুতিনের বুহ্য ভেদ করতে পারবেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো ইউরোপে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানায় পরিবর্তন ঘটান পুতিন।

সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ২০১৪ সালে দখল করেন ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। পূর্ব ইউক্রেনে একটি যুদ্ধের প্ররোচনা ও ইন্ধন জোগায় রাশিয়া। এতে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের শেষদিকে ইউক্রেনের পূর্ব ও উত্তর সীমান্ত এবং দখলকৃত ক্রিমিয়ায় লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করে মস্কো।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুতিন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘আমার কি মনে করা উচিত- তিনি পশ্চিমকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এবং ন্যাটোকে পরীক্ষা করবেন, যতটা তার পক্ষে সম্ভব? হ্যাঁ, আমি মনে করি, সে পরীক্ষা করবে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের সময় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয় ইউক্রেন। দেশটির এই স্বাধীনতা ছিল জটিল শীতল যুদ্ধের ফল, তখন ইউক্রেনে ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পরমাণু অস্ত্রের মজুদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অ-রাশিয়ান রাষ্ট্র হিসেবে কাজাখস্তান এবং বেলারুশেরও উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু পরমাণু অস্ত্রের মজুদ ছিল শুধু ইউক্রেনেই।

যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রবল বৈশ্বিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ঠেকাতে সক্ষম হয়। যা একটি পারমাণবিক পরাশক্তির উত্থান রোধে ছিলো বড় ঘটনা। এই জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণেই সই হয় বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম বা স্মারকলিপি। আর এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয় ইউক্রেনের নিরাপত্তা।

ইউক্রেন একটি অ-পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করায় দেশটির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং বিদ্যমান সীমানাকে মেনে নেয় রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। বুদাপেস্ট স্মারকলিপি অনুযায়ী, ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের হুমকি বা শক্তির প্রয়োগ থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকতে হবে। এতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো এই নিশ্চয়তাও দিয়েছে যে, ইউক্রেন যদি কোনো আগ্রাসনের শিকার হয়, তাহলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে তারা সহযোগিতা করবে।

জাতিসংঘ সনদ এবং ১৯৭৫ সালের চূড়ান্ত হেলসিংকি আইনে থাকা বাধ্যবাধকতাগুলোও ইউক্রেনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। ইউক্রেন তার সীমানার মধ্যে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রগুলো পর্যায়ক্রমে পরিত্যাগ করে। সেগুলো ধ্বংস করার জন্য রাশিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল এবং বর্তমানে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের জন্য তার হুমকি এখন এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে , বুদাপেস্ট স্মারকলিপির তাৎপর্য কী?

১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত সেই স্মারকলিপি নিয়ে আজ অনুতপ্ত ইউক্রেনীয়রা। যদিও আইনগতভাবে সেটি মানা বাধ্যতামূলক নয়। তারপরও এটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা প্রদান করে। যার মধ্যে আছে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, আন্তর্জাতিক সীমান্ত লঙ্ঘন না করা এবং হুমকি অথবা শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা।

ইউক্রেনের পারমাণবিক অস্ত্র বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে , তারা বিচ্ছিন্ন না থেকে বরং একটি পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহাবস্থান করতে চেয়েছিল। এটি শুধুই প্রতীকী সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ ইউক্রেন যেখানে নিজেকে পরিপূর্ণ পারমাণবিক ক্ষমতার উত্তরাধিকারী বানায়নি, সেখানে ঠিকই রাশিয়া এখনও পারমাণবিক অবকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অথচ সেটা করার প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত এবং শিল্প সক্ষমতা ইউক্রেনের ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also

উত্তেজনার মধ্যে আবার মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন ব্লিঙ্কেন

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আজ বৃহস্পতিবার নতুন করে মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু …